রংপুর অঞ্চলে তামাকের আগ্রাসন: বাড়ছে তামাক চাষের জমি

রংপুর অঞ্চলে তামাকের আগ্রাসন: বাড়ছে তামাক চাষের জমি

[কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল]

Tamak Photo 02দুই চোখ মেলবেন, দেখবেন তামাক ভরা ক্ষেত। বুক ভরে নি:শ্বাস, তারও উপায় নেই। হাওয়ায় তামাটে গন্ধ। ঘরের আঙিনায় পা ফেলবেন, ফুসরত নেই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তামাক পাতা। মাঠ-ঘাট কিংবা রাস্তার ধারে বাঁশের বেড়া, কোথাও খালি নেই। রোদে শুকানো হচ্ছে তামাক। বাড়ি বাড়ি শুকনো তামাকের স্তুপ করে মাচা ভর্তি করা হচ্ছে। আর এসব কাজে ব্যস্ত নারী পুরুষ,এমনকি শিশুরাও। রংপুর অঞ্চলে তামাক পাতায় তৈরি হচ্ছে বিড়ি-সিগারেট-গুলসহ বিভিন্ন নেশাজাতীয় দ্রব্য। প্রাণঘাতক নিকোটিন আছে জেনেও দেদার চলছে তামাক চাষ! ভয়ংকর এই তামাক আবাদে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হলেও রংপুরে এখন চলছে তামাকের ভরা মৌসুম। হঠাৎ করে গ্রামে আসা অনেকেই তামাকের উৎকট গন্ধে নাকে রুমাল চেপে পথ চলছেন। রংপুর সদর, বদরগঞ্জ, তারাগঞ্জ ও গঙ্গাচড়া,কাউনিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে তামাক চাষের এমন ব্যাপকতা।
Tamak Photo 06তামাকের ভয়াবহতা জেনেও রংপুর অঞ্চলের কৃষকদের তামাক আবাদ থেকে মুখ ফেরানো যাচ্ছে না। অন্য ফসলে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা ঝুঁকছেন তামাক চাষে। দিনে দিনে বাড়ছে এ অঞ্চলে তামাক আবাদের জমি। কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করতে মাঝে মধ্যে সভা, সেমিনার হয় । কিন্তু বাস্তবে কাজের কাজ কিছুই হয় না। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাবে এবার রংপুরের ৮ উপজেলায় তামাক চাষ দেখানো হয়েছে মাত্র ২ হাজার ৫ শত ২২ হেক্টর জমিতে। কিন্তু এর উল্টো চিত্র দেখা গেছে এবার তামাক আবাদের ব্যাপকতা দেখে। ধারণা করা হচ্ছে, রংপুরে তামাক চাষ হয়েছে কমপে ১৫ হাজার হেক্টর জমিতে। রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর, হরিদেবপুর, চন্দনপাট ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ি বাড়ি তামাকের আবাদ। বেশি লাভের আশায় কৃষকরা তামাক চাষ করছে। তামাকের ভয়াবহতা আছে জেনেও বেশি লাভের আশায় দিনদিন বাড়ছে তামাক চাষের জমি।
রংপুর সদর উপজেলার মমিনপুর ইউনিয়নের কৃষক মনতাজ আলী  এবার প্রায় ১৫০শতক জমিতে তামাক চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তামাকের তেমন রোগ-বালাই হয় না। কায়ো হামাক তামাক আবাদ কইরবার নিষেদ করে না। নগদ টাকার জন্যে হামরা তামাক চাষ করুচি।  আলু আবাদ করিয়া খালি লোকসান। দুই টাকা কেজি আলু তাও বিক্রি নাই। আর তামাক চাষ করলে হামাক তেল নাগায়। কম্পানির লোক বাড়ি থাকি তামাক কিনি নিয়া যায়।’ ওই এলাকার ছোট মটুকপুর গ্রামে কৃষক এমদাদুল হক বলেন, ‘মনে হয় তামাকোত বিষ আছে। ওই কারণে শরীরের টেম্পার জিনিসটা থাকে না। কান্ত মনে হয়। মাঝে মধ্যে দম বন্ধ হয়া আইসে। কষ্ট বেশি হইলেও লাভের জন্যে হামরা তামাক আবাদ করুচি।’ একই ধরণের কথা বলেন, কাউনিয়া উপজেলার হারাগাছ ইউনিয়নের চরাঞ্চলের কৃষক মোস্তফা ও আমিনুল ইসলাম।
জানা যায়, রংপুরে ব্যাপকহারে তামাক প্রক্রিয়াজাতকরণসহ তামাক নির্ভর কারখানা গড়ে ওঠায় জনজীবন বিপন্ন হওয়ার আশংকা করা হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন বিড়ি কারখানায় শিশু ও নারী শ্রমিকরা যা, শ্বাসকষ্টসহ নানা ধরনের জটিল চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, রংপুরে তামাক কারখানা থেকে বিষাক্ত ধুলি কনা ও খালি পেটে থেকে অধিকহারে ধূমপানের কারণে ‘বার্জাস’ নামে এক ভয়াবহ রোগে প্রতিনিয়তই লোকজন আক্রান্ত হচ্ছে। এ রোগে আক্রান্ত হলে হাত বা পায়ে ত দেখা দেয়।  দ্রুত পচনশীল এ রোগের চিকিৎসা অধিকাংশ লোকের পা কিংবা হাতের তের সৃষ্টি হলে তা এক সময় কেটে ফেলতে হয়। ওই সূত্র মতে, গত ১৫ বছরে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে পাঁচ শতাধিক ব্যক্তির পা কেটে ফেলতে হয়েছে। এছাড়াও টিউবার কোসিস বেসিলার (টিবি)  কিনিকগুলোর পরিসংখ্যান অনুয়ায়ী একই সময়ে যা রোগের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ১৫ শতাংশ। এদের মধ্যে সঠিক চিকিৎসার অভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে প্রায় ৬ শতাংশ। এছাড়া এ অঞ্চলে প্রায় ৪০ শতাংশ লোক শ্বাসকষ্ট ও গলায় বিভিন্ন রোগে (গলগন্ড) আক্রান্ত হয়েছে। তামাক কারখানায় কর্মরত নারীদের গর্ভজাত সন্তান শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে পারে। এমন অবস্থায় অনেক শিশু বিকলাংগ হয়ে জন্ম নিচ্ছে।
তামাক চাষ থেকে দূরে থাকতে শহর ভিত্তিক প্রচার প্রচারনা থাকলেও প্রত্যন্ত গ্রামে সাধারণ মানুষের কাছে এসব বার্তা পৌঁছে না। আর পৌঁছালেও তামাক চাষীদের কাছে আর্থিক বিষয়টিই বেশি গুরুত্ব পায়। তামাক আবাদে আর্থিকভাবে কৃষকরা যে হারে লাভবান হয়, অন্য কোন ফসলে তা হয় না। তামাক মানবদেহের জন্য তিকর বলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে গত কয়েক বছর ধরে তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করে আসছে। তারা নামে মাত্র কৃষকদের নিয়ে বিভিন্ন সভা সমাবেশ বা কর্মশালা করেছে। কর্মশালায় তিকর দিকগুলো তুলে ধরা হয়। তামাকের পরিবর্তে আলু,গম, ভুট্টা ,সরিষাসহ অন্যান্য ফসল আবাদের পরামর্শ দেওয়া হলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দিনদিন তামাকের আবাদ বাড়ছে। তামাক চাষ থেকে কৃষকদের ফেরানো যাচ্ছে না। তামাক চাষের  কারণে এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কম্পানীর বড় বড় গোডাউন। তারা তামাক কিনে গুদামজাত করছেন।
Tamak Photo 05কৃষি বিভাগ থেকে দাবি করা হয়েছে, এ অঞ্চলে তামাকের আবাদ কমে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এ বছর রংপুর অঞ্চলে ব্যাপক হারে তামাক আবাদ হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তামাক আবাদ হয় রংপুর সদর, গংঙ্গাচড়া, কাউনিয়া,তারাগঞ্জ, বদরগঞ্জ, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম, কালীগঞ্জসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে। এছাড়া এখন রংপুর অঞ্চলের প্রায় সব উপজেলাতেই তামাক চাষ ছড়িয়ে পড়ছে। এ অঞ্চলে বিড়ি সিগারেট ফ্যাক্টরীর পাশাপাশি অনেক নতুন নতুন গুল ফ্যাক্টরীও গড়ে উঠেছে। এ কারণে তামাকের চাহিদাও বেড়ে গেছে বহু গুণ।
তারাগঞ্জের ইকরচালী গ্রামের তামাক চাষি মকছেদুল হক বলেন, বিভিন্ন কম্পানির লোকজন আমাদের আগাম টাকা ও কীটনাশক দেয়। এজন্য এবার আরও বেশি জমিতে তামাক আবাদ করছি। একই কথা বললেন বদরগঞ্জের মধুপুর ইউনিয়নের কৃষক মোকছেদুল হকও।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা (উন্নয়ন) নজরুল ইসলাম বলেন, তামাক চাষে কৃষকদের নিরৎসাহিত করা হচ্ছে। কিন্তু বিভিন্ন বিড়ি সিগারেট কম্পানি তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। প্রলুব্ধ হয়ে কৃষকরা নেমে পড়ছে তামাক চাষে।


jahed rubelলেখক:
কৃষিবিদ জাহেদুল আলম রুবেল
কান্ট্রি এডিটর, মফস্বল বিভাগ
দৈনিক কালের কণ্ঠ
বসুন্ধরা, বারিধারা, ঢাকা।